ব্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টের সাতকাহন

ব্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টের সাতকাহন

ব্যান্ডসংগীতের অন্যতম মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট গিটার, কীবোর্ড ও ড্রামস। অন্যান্য যন্ত্রও থাকে। কিন্তু এই তিনের উপস্থিতি অবধারিত। তবে যুগের তালে কিছু ব্যান্ড নিজেদের গানের কম্পোজিশনে ব্যবহার করছে ভিন্ন ঘরানার গানে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলোও। সেগুলোর মধ্যে মেন্ডুলিন, এসরাজ, বেহালা, সরোদ উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়াও সেতার ও হারমোনিয়ামও যুক্ত হচ্ছে। দেশের বাইরের ব্যান্ডগুলো তো আরেককাঠি সরেস হয়ে উঠেছে। স্যাক্সোফোন থেকে জাইলোফোন, সবই ঠাঁই পাচ্ছে রেকর্ডিংয়ে।

ব্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টের সাতকাহন
গিটার

গিটার ছাড়া ব্যান্ডসংগীত যেন অকল্পনীয়। এর আছে পৌরানিক ইতিহাস। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলর হাতে একটি বাদ্যযন্ত্র দেখা হায়। যন্ত্রটি বর্গাকার। এটিকেই গিটারের আদিরূপ হিসেবে ধরে নেন বিশ্লেষকরা। ভিন্নমতও আছে। ৪০০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ‘সিথারা’ নামের একটি ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার শুরু করে। সেটি থেকেই গিটারের বিবর্তন বলে মত দিয়েছেন ব্রিটিশ লেখক মরিস জে. সামারফিল্ড। আবার, সিথারা তৈরিতে গ্রিকদের একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রভাব আছে বলেও কথিত আছে।

গিটারের উৎপত্তি নিয়ে আরও কিছু মতামত আছে। প্রাচীন আরবরা ‘উদ’ নামের একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাত। সেটি বিবর্তিত হয়ে গিটার এসেছে হয়তো। কিংবা চারটি তার যুক্ত ‘তানবুর’ থেকেও গিটারের উৎপত্তি হতে পারে। এই যন্ত্রটি ছিল হিটরাইটদের। তারা ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বে সিরিয়ায় বাস করত। তবে এই তানবুরাকে তানপুরার আদিরূপ হিসেবে ভাবেন অনেকে। মানে তানপুরা বিবর্তিত হয়ে গিটার হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

ব্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টের সাতকাহন
তানপুরা

১২০০ সালে দুটি বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। সেগুলোর একটি হচ্ছে মুরিশ গিটার। এর পেছনের দিক্টি ছিল গোলাকার। ফ্রেডগুলো এখনকার গিটারের মতো প্রশস্ত নয়। তাতে একাধিক সাউন্ডহোল ছিল। আরেকটি হচ্ছে লাতিন গিটার। এতে চারটি তার এবং হোল একটি। এটির ফ্রেড বোর্ড তুলনামূলকভাবে চওড়া। ১৭৮৮ সালের আগে কিছু গিটার দেখা যায় পাঁচ তারওয়ালা। সেই সালে গিটারে ষষ্ঠ তার জুড়ে দেন জার্মান বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা জ্যাকব অটো। তখন থেকে ছয় তার বিশিষ্ট আধুনিক গিটার জনপ্রিয় হতে থাকে। তারের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে বর্তমানে তিন প্রকারের গিটার রয়েছে। স্প্যানিশ, হাওয়াইয়ান এবং বেজ গিটার।

এবারে আসা যাক ড্রামস বিষয়ে। কমবেশি সবাই এটিকে চেনে। দেশভেদে এর আকার-আকৃতিতে পার্থক্য আছে। যেমন, পাশ্চাত্য সংগীতাঙ্গনে সিলিন্ডার আকৃতির ড্রামস বেশি ব্যবহার হয়। টিমবেল ড্রামের মতো এটির একদিক খোলা থাকে। কখনো কখনো ড্রামে একাদিক ড্রামহেড থাকে। এক হেড যুক্তটিতে একটি চামড়া টানটান করে যুক্ত থাকে। দুই হেড যুক্তগুলোর মধ্যখানে একটি ছিদ্র থাকে। ফলে ড্রামের ভেতর অনুনাদ সৃষ্টি হয়ে শ্রুতিমধুর শব্দ তৈরি হয়। আফ্রিকান স্লিটড্রাম কিছুটা ব্যতিক্রম। তা গুড়ি ড্রাম নামেও পরিচিতি মিউজিশিয়ানদের কাছে। কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি হয় এই ড্রাম। তবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে তা বানানো হয় স্টিল দিয়ে। দুই ড্রামহেড যুক্ত যন্ত্র মূলত একগুচ্ছ তার দিয়ে যুক্ত থাকে। তারগুলো স্নেয়ার নামে পরিচিত। গানের ধরনভেদে ড্রাম ব্যবহারে তারতম্য দেখা যায়। যেমন, জ্যাজ ঘরানার শিল্পীদের পছন্দ সল্প শব্দ তৈরি করে- এমন ড্রামস। রকশিল্পীরা আবার বিপরীত। তাদের লাগে লাউড সাউন্ডের ড্রামস। ড্রামসের উৎপত্তি প্রাচীন মিসরে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০০-২৩৫০ এর সময়ে চীনে কুমিরের চামড়ার তৈরি ড্রামের হদিস মেলে। শুরুতে ড্রামস মূলত বিভিন্ন ধর্মীয় আচার পালনে ব্যবহৃত হতো। ব্রোঞ্জ যুগের ভিয়েতেনামের উত্তরে ডং সান সভ্যতায় ব্রোঞ্জের তৈরি ড্রাম ছিল।

দেশি ব্যান্ডসংগীতে আগে বেহালার তেমন ব্যবহার না হলেও এখন হচ্ছে। পাশ্চাত্য ব্যান্ডগুলো তা হরহামেশাই দেখা যায়। কেউ কেউ অবশ্য বেহালাকে ভারতে উদ্ভুত বাদ্যযন্ত হিসেবে দাবী করেন। কেউ বলেন ইউরোপিয়ান। ভারতীয় মতে, এই বাদ্যযন্ত্রের সূচনা রাবনের আমলে। পাঁচ হাজার বছর আগে রাবন দুই তার বিশিষ্ট একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন। সেটির আদল ছিল বেহালার মতো। ভিন্নমতে, আরবরা স্পেন দখলের পর ইউরোপ ও মুসলিম সংস্কৃতির যে ধারা সৃষ্টি হয়ে

ব্যান্ড ইন্সট্রুমেন্টের সাতকাহন
বেহালা

ছিল তখন তিন তার বিশিষ্ট একটি বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। সেটিও দেখতে ছিল বেহালার মতো। তাই মুসলিম জনগোষ্ঠী এটিকে আরবীয় বাদ্যযন্ত্র মনে করে। বেহালার উৎপত্তি নিয়ে যতই মতভেদ থাকুক না কেন, সেটিকে পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গঠনের স্বীকৃতি ফ্রান্সের ক্রিমোনা সঞ্চলের আন্দ্বে আমেতিকে দেওয়া চলে। ধারণা করা হয় ১৭০০ সালের দিকে তারই প্রপৌত্র নিকোলা আমেতির ছাত্র অ্যান্টেনিও স্ট্যাডিয়াভ্যারিয়স বেহালার বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন করেন।

ব্যান্ডসংগীতে পিয়ানোর ব্যবহারও চোখে পড়ে। তবে এটি খুব একটা বহনযোগ্য নয়। তা ছাড়া খুবই ব্যয়বহুল। তাই এর বদলে কিংবা এরই স্বরূপ আরেকটি যন্ত্র পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। যেটির নাম কীবোর্ড। পিয়ানোর সঙ্গে এর খুব সামান্যই পার্থক্য। প্রাচীনকালে যখন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সূচনা ঘটে, ঠিক তখনই পিয়ানোর জন্ম। প্রথম দিকের পিয়ানোর নাম ছিল হ্যামারড ডালকিমার। এটি মূলত তারের তৈরি বিশেষ স্বরযন্ত্র। তারকে আঘাত করলে অনুরণিত হতো। ফলে শ্রুতিমধুর শব্দ তৈরি হতো। মধ্যযুগে চাবিচালিত ডালকিমার তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। সতের শতকে তা সফলতা পায়। তখন চাবিযুক্ত ক্লাভিকর্ড (Clavichord) ও হার্পসিকর্ড (Harpsichord)  সংগীতপ্রেমিদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিল। হার্পসিকর্ডের তারগুলোকে পাখির পালক দিয়ে বাজাতে হতো। সেটি উন্নত হতে হতেই বর্তমানের কীবোর্ড তৈরি হয়্নে

বর্তমানে যেসব পিয়ানো দেখা যায়, সেটি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া চলে ইতালির পাদুয়ার বার্তোলোমেয়ো ক্রিস্টোফারিকে। তিনি ১৬৫৫ সালে জন্মে ১৭৩১ সালে মারা যান। তিনি ছিলেন একজন হার্পসিকর্ড বিশেষজ্ঞ। তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন তিনি। তবে এটা জানা যায়নি যে কবে প্রথম ক্রিস্টোফারি তার প্রথম পিয়ানোটি তৈরি করেছিলেন। ক্রিস্টোফেরি তিনটি পিয়ানো এখনও টিকে আছে। সেগুলো মূলত ১৭২০ সালে তৈরি হয়েছিল।

আজকাল ব্যান্ডশিল্পীরা গতানুগতিক বাদ্যযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছেন। সরোদ, মন্দিরা কিংবা তবলা- সবই ব্যবহার হচ্ছে কম্পোজিশনে।

 

ছবিঃ ইন্টারনেট