ফিরে এসো কলের গান…

ফিরে এসো কলের গান...

১৮৭৭ সালের ২৯ নভেম্বর। কথা বলতে পারে এমন একটি যন্ত্র জনসম্মুখে নিয়ে এলেন বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসন। এর আগে কোনো লোহা-লক্করের যন্ত্র মানুষের মতো কথা বলতে পারেনি। যন্ত্রটি বলে উঠল ‘Good morning. How do you do? How do you like the phonograph?’ সকলের পিলে চমকানোর উপক্রম। চোখ ছানাবড়া।

থমাস আলভা এডিসন ও তাঁর গ্রামোফোন
থমাস আলভা এডিসন ও তাঁর গ্রামোফোন

গল্পটা গ্রামোফোনের। শব্দবন্দি করে যখন খুশি বাজিয়ে শোনার এক জাদুকরী কল। যন্ত্রটির রূপকার এডিসন হলেও, তাকে একচেটিয়া কৃতিত্ব দেওয়া চলে না। গ্রামোফোনের পুরো যাত্রায় তার অগ্রজ বিজ্ঞানীদের ভূমিকা আছে। কবি ও ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও উপেক্ষার জো নেই। ফরাসি কবি চার্লস ক্রোসের মনে শব্দবন্দি করে পরবর্তীতে তা শোনার ইচ্ছা জাগে। অনেক ভেবেচিন্তে এক অভিনব পদ্ধতি প্রতিবেদনরূপে জমা দিয়েছিলেন ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমিতে। তবে কবি ক্রোসের আগেই শব্দবন্দি করার সাধ জেগেছিল আরেকজন বিজ্ঞানীর মনে। পার্চমেন্ট কাগজে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন বিজ্ঞানী Édouard-Léon Scott de Martinville। কিন্তু তাদের কারো তরীই তীরে ভেড়েনি। তবে তাদের কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে চূড়ান্তে পৌঁছে যান থমাস আলভা এডিসন। যদিও আমরা গ্রামোফোন বলতে যা বুঝি, এডিসনেরটি মোটেও সেরকম ছিল না। গ্রামোফোনের চোঙাটিও কিন্তু তিনি যুক্ত করে যাননি। তার যন্ত্রে সমতল ডিস্ক বাজানোর ব্যবস্থাও ছিল না। শব্দ গ্রহণ ও পুনরাবৃত্তির অংশটি ছিল রুটি বেলার বেলনের মতো। এডিসনের কথা বলা যন্ত্রের উপর ঐ চোঙা ও সমতল ডিস্ক বাজানোর প্রযুক্তি সংযুক্ত করেন এমিল বারলিনার। ১৮৮৭ সালে। তিনিই এই কলের নাম দেন গ্রামোফোন। এটিই ১৯০০ সালে ভারতবর্ষে পৌঁছে এবং সংগীতাঙ্গনে প্রযুক্তিগত তুমুল বিপ্লব নিয়ে আসে। ভাগ্য বদলে যায় কিছু ব্যবসায়ী ও শিল্পীর। সংগীতভুবনে অমরত্ব পান গওহর জানের মতো আরও অনেক কণ্ঠশিল্পী।

ফিরে এসো কলের গান...
গ্রামোফোন

বাঙালীকে গ্রামোফোনের নেশা ধরিয়ে দেন ‘ফ্রেডরিক উইলিয়াম গেইসবার্গ’ নামের একজন মার্কিন শব্দপ্রকৌশলী। মিউজিশিয়ানও। গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম ইঞ্জিনিয়ার তিনিই। গ্রামোফোন নিয়ে ১৯৯০ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত বহুবার ভারতবর্ষে আনাগোনা করেছেন গেইসবার্গ। ১৯০২ সালের ৮ নভেম্বর ঐতিহাসিক একটি ঘটনার জন্ম দেন এই মিউজিশিয়ান। ক্ল্যাসিক থিয়েটারের চতুর্দশী নৃত্যশিল্পী ‘মিস শশী মুখী’কে দিয়ে রেকর্ড করিয়ে ফেলেন একটি কীর্তন- ‘কাঁহা জীবন ধন…’। সেদিনই ঐ থিয়েটারের আরেক নৃত্যশিল্পী ‘মিস ফনী বালা’র কণ্ঠ রেকর্ড করেন। পরের দিন আরও কজনের কণ্ঠ নেন। কিন্তু ১১ নভেম্বরে নেওয়া একটি রেকর্ড জন্ম দেয় একজন কীর্তিমান কণ্ঠশিল্পীর। নাম তার গওহর জান। রূপের ছটা ও রেওয়াজি কণ্ঠে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সংগীতানুরাগীদের। ‘ভালো বাসিবে বলে বাসিনে…’ গওহরের কণ্ঠে রেকর্ড করা প্রথম গান সংগীতানুরাগীদের শ্রবণেন্দ্রিয়কে বিচলিত করে তুলেছিল সে সময়। সাত ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড হচ্ছিল তার সুরেলা কণ্ঠের গানগুলো। পরের দিন আবারও রেকর্ড করা হয় তার গান। কয়েকগানেই বাজিমাত। গওহরের রেকর্ড সেসময় এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে কলকাতার সব ক’টি সংবাদপত্রের একেবারে প্রথম পাতায় ছবিসমেত ছাপা হয় তার কীর্তিকথা। অল্পসময়ের মধ্যেই গোটা ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে গ্রামোফোনের বড় বিশ্ববাজার।

গেইসবার্গ যে শুধু শশী মুখী, ফনী বালা, গওহর জান, হরিমতি ও সুশীলার মতো নারীদের কণ্ঠই রেকর্ড করেছিলেন, তা নয়। পেয়েছিলেন ‘লালচাঁদ বড়াল’এর মতো রত্নকেও। এই পুরুষ কণ্ঠশিল্পী খ্যাতিতে ছিলেন গওহর জানের সমকক্ষ। গেইসবার্গ ভারতবর্ষে কলের গানের এই মহাবিপ্লব ঘটাতে সময় নিয়ে ছিলেন মাত্র ছয় সপ্তাহ। এত অল্প সময়ে মোট ৬৫২টি রেকর্ড নিয়েছিলেন এই প্রকৌশলী। গ্রামোফোনের জনপ্রিয়তা এতই তুঙ্গে ছিল যে, ১৯০৩ সালে ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মোশাররফ হোসেনের কুষ্টিয়ার বাড়িতেও তা পৌঁছে যায়। এটিই হলো কোনো মুসলিম পরিবারে কলের গান পৌঁছুনোর প্রথম নজির।

গেইসবার্গ তো উপমহাদেশে কলের গানের চাবি ঘুরিয়ে দিলে গেলেন। কিন্তু সেটির বাণিজ্যিকরূপ দেন ভারতীয় ব্যবসায়ী হেমেন্দ্র মোহন বসু। গ্রামোফোনের ইতিহাসে তার নাম সোনার অক্ষরে বাধা থাকবে। ১৯০০ সালে গ্রামোফোন তৈরির কলাকৌশল ভারতবর্ষে আমদানি করেন তিনি। কলের গান রেকর্ড করার কোম্পানি করে সেসব রেকর্ড বিতরণ শুরু করেন গোটা ভারতবর্ষে। এই সেকটরে তার ছিল একচেটিয়া ব্যবসা। ‘এইচ বোস’স রেকর্ড’- এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বাংলাসাহিত্যের ভীষণ কদর করতেন এই ব্যবসায়ী। তার উদ্যোগেই জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, এবং দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের আবৃত্তি, বাণী ও সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা সম্ভব হয়েছিল। খোদ রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে তাঁরই রচিত গান ও কবিতার রেকর্ড ও বের করেন এইচ বোস।

ফিরে এসো কলের গান...
কমপ্যাক্ট ডিস্ক

গ্রামোফোন তৈরি ও বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে আরও ক’জন ভারতবর্ষীয় ব্যক্তির নাম উঠে আসে। বিশেষ করে মানিক লাল শাহা। তা ছাড়া আছেন মীনা পেশোয়ারি নামক এক অবাঙালি। তিনি ‘শাহন শাহ’ রেকর্ড কোম্পানী নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯২৬ সালে। ত্রিশের শতকের গোড়ার দিকে চন্ডীচরণ সাহা, বিভূতিভূষণ ও জিতেন্দ্র নাথ গড়ে তোলেন স্বদেশী রেকর্ড কোম্পানী ‘মেগাফোন’, ‘হিন্দুস্তান’ ও ‘সেনোলা’। পরবর্তীতে অবশ্য আরও দেশীয় রেকর্ড কোম্পানী তৈরি হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- পাইওনিয়ার, ভারত, রিগ্যাল, মেল-ও-ডি ও কোহিনূর।

আবারও একটু পেছনে যাওয়া যাক। ১৯০১ সাল নাগাদ ১০ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড বাজারজাত করেছিল বিদেশি কোম্পানি Victor Talking Machine। বাজারে ১২ ইঞ্চি ব্যাসের ডিস্ক আসে ১৯০৩ সালে। কিন্তু এসব রেকর্ডের বাদনকাল ছিল মাত্র দুমিনিট। টমাস আলভা এডিসন সেটিকে চার মিনিটে উন্নীত করেন। ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে গ্রামোফোন। ছোট রেকর্ড থেকে ক্রমশ লংপ্লে রেকর্ড তৈরি হতে লাগল। এক রেকর্ডে দুই পিঠে ৮টি করে গান থাকত। তারপর গ্রামোফোনের বদলে এল রেকর্ড প্লেয়ার। এরপর অটো রেকর্ড প্লেয়ার। তারপর বড় ফিতার স্পুল রেকর্ডার। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত দেদারসে চলেছে ছোট ফিতার ক্যাসেট রেকর্ডার। প্রতিটি ক্যাসেট এপাশ-ওপাশ মিলে গান বাজত এক ঘণ্টা। পরে গান শোনার ক্যাসেটের সঙ্গে চলে এল ভিডিও ক্যাসেট। হারিয়ে গেল ক্যাসেট। এলো কমপ্যাক্ট ডিস্ক; সংক্ষেপে সিডি। এর পরপরই এল ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক তথা ডিভিডি। এত সব ডিভাইসের ভিড়ে হারিয়ে গেল গ্রামোফোন। প্রগতির গুতোয় সেটির ঠাঁই হলো জাদুঘরে। কেউ সেটিকে স্মরণ করে না। হারিয়ে গেল স্মৃতি থেকেও। এক সময়ের দাপুটে যন্ত্রের এই করুণ দশা সত্যিই বেদনার। এখনো অনেক প্রবীণের স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে যন্ত্রটি। সুযোগ পেলেই সেই যন্ত্রের কথা তোলেন। ফিরে যান গ্রামোফোনের সঙ্গে মিশে থাকা শৈশব স্মৃতির সাদাকালো অধ্যায়ে। প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী তিমির নন্দী আমাদের সঙ্গে মুঠোফোনে ব্যক্ত করেছেন গ্রমোফোনের সঙ্গে যুক্ত থাকা তার শৈশবস্মৃতি। বললেন, ‘আমাদের বাসায় ছিল গ্রামোফোন। আমার ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে। পিকনিকে গিয়েছিলাম স্কুল থেকে। গ্রামোফনে গান বাজছিল। আমি বসে বসে সেই গানের কথা লিখেছিলাম। সুরটা আয়ত্ত করতে চেষ্টা করছিলাম। গান শেখার ক্ষেত্রে গ্রামোফোন এভাবেই যুক্ত আছে আমার স্মৃতিতে।’

আর কখনো কি ফিরে আসবে গ্রামোফোনের হারানো জৌলুস? হ্যাঁ, ফিরেছে। নতুন নামে ফিরে এসেছে গ্রামোফোন। এখন সেটির নাম টার্ন টেবিল। রেকর্ডের নাম লংপ্লেয়ার; সংক্ষেপে এলপি। চাহিদাও আছে। ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে ৩ কোটি ২৫ লাখ এলপি বিক্রি হয়েছে। জরীপে দেখা গেছে, ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ক্রেতারা এলপির দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এ তো কলকাতার চিত্র। সেবছর শুধু ঢাকাতেই তিন হাজারের বেশি পুরোনো এলপি হাতবদল হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২০ সালে এসেও ঢাকাতে ট্রার্ন টেবিল ও এলপি সংগ্রাহকের সংখ্যা কম নয়। তাদের আগ্রহের তালিকার শীর্ষেই আছে এই যন্ত্রটি।

ফিরে এসো কলের গান...
এল পি (LP)

নগরীর ইস্কাটন গার্ডেনের বাসিন্দা মো. দিদারুল ইসলাম সুজন। শৌখিন কালেকটর। গ্রামোফোন থেকে টার্ন টেবিল, সব কিছুতেই ভীষণ কৌতূহল তার। এসব বিষয়ে আলাপ তোলার পর তিনি বললেন, ‘আমার কাছে এলপি হচ্ছে মিউজিকের একটি পিওর ফর্ম। অডিওতে আমরা যে ধরনের সাউন্ড কোয়ালিটি চাই, এলপিতে তা পাই। এখন আমরা তো সবাই ডিজিটাল, এলপিগুলো হচ্ছে এনালগ। এটার সাউন্ড প্যাটার্ন, ওয়েবলেন্থ সব হচ্ছে এনালগ। আর এনালগ হচ্ছে পিওর মিউজিক। ঠিক এ কারণে আমি এবং অন্যান্য কালেকটররা এটি পছন্দ করেন।

আমার সংগ্রহে ষাট ও সত্তর দশকের কিছু গ্রামোফোনও আছে। আমার কাছে এমন কিছু আছে যা অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া আধুনিকগুলো তো আছেই।’

গ্রামোফোনের এত গৌরবময় যাত্রা ও সেটির হারিয়ে যাওয়া আমাদের সমস্ত চৈতন্যে একযোগে স্পর্শ করেছে। আমরাও ঝুঁকে পড়েছি আধুনিক টার্ন টেবিল ও এলপির দিকে। মাল্টিমিডিয়া কিংডমের কর্নধার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জুয়েল নিজে সংগীতশিল্পী না হলেও সংগীতানুরাগী পরিবারেই তার জন্ম। বাবা ছিলেন পুরোদস্তুর গায়ক। তাই সংগীত ও সংগীত বাজানোর যন্ত্রের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা তার। নিজেই অনেক এলপি সংগ্রহে রেখেছেন। সংগীতপ্রেমিরাও যেন গ্রামোফোন ও টার্ন টেবিলের সান্নিধ্য পান, সংগীত বিষয়ে তার অনেক প্রত্যাশার মধ্যে এটিও একটি। তার আকাঙ্ক্ষা- সংগীত প্রেমিদের ঘরেও একটি টার্ন টেবিল শোভা পাক। থাকুক সংগীতের কিছু ভিনটেজ কালেকশন। যাতে উত্তরসূরিদের সঙ্গে সেসবের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়। পুরনো ও আধুনিকের মেল বন্ধনের সাক্ষী হয়ে উঠতে পারে একটি টার্ন টেবিল।

কলের গানের এসব ফ্যাসিনেশন থেকে পুরনো দিনের গ্রামোফোন ও নতুন দিনের টার্ন টেবিল নিয়ে কাজ করি আমরা। তারই ধারাবাহিকতায় অডিও টেকনিকের পণ্য সরবরাহ করছি। সেসব পণ্য এক নজরে দেখে নিতে খানিকটা সময় ব্যয় করা যেতে পারে আমাদের লিঙ্কে:

audio-technica