গানের উৎপত্তি

4

‘নাচ-গান’ জানা আছে? নৃত্য ও গীতের এই শব্দজোড়ে নৃত্যকেই প্রথমে রাখা হয়। কেউই ‘গান-নাচ’ বলে না। বলে ‘নাচ-গান’। আগে নাচ পরে গান। কেন? গানের উৎপত্তিকথার বয়ানে নাচকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। কেননা, নাচই হচ্ছে গানের বীজ, গানের আদি, গানের মাতা। আধুনিক মানসিকতা নিয়ে এই দুই কলার সম্বন্ধ যাচাই কঠিন হবে। গানের উৎপত্তি বুঝতে হলে চিন্তাকে প্রস্তুত করতে হবে আদিম মানুষের মতো করে। একেবারেই গুহাবাসী দশায়। যদিও এখানের মূল আলোচ্য নাচ নয়, গান বিষয়ে। তবে ঐ যে বলা হলো – নাচই গানের মাতা। তাই নাচের কথা না বলে গানের আঁতুড়ঘর খুঁজে বের করা সম্ভব নয়।

আদিম মানুষ নাচত। কেন নাচত? না, এখনকার মতো নিছক বিনোদনের জন্য নয়। সেই নাচ হালের মতো এতো শিল্পঠাঁসাও ছিল না। নাচ ছিল আদিম মানুষের টিকে থাকার কৌশল। দলীয়নৃত্য ছিল কাজেরই অংশ। আদিম শিকার-সংগ্রাহক মানুষ দলগতভাবে শিকারে বেরোতো। তবে এই কাজ খুব সহজ ছিল না। শিকার সহজলভ্যও নয়। কাঙ্ক্ষিত প্রাণীটির পেছনে দৌড়ানো, চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলা, ফাঁদে ফেলে শিকার করা – এই সব কিছুর জন্যই দরকার ছিল পূর্বপ্রস্তুতি তথা মহড়া। প্রস্তুতি চলত তাদের ডেরার উঠোনেই। শিকারে যাওয়ার আগে।

6

যে প্রাণীটি শিকার করা হবে সেটির খুলির কঙ্কাল নিজেদের মাথায় পরে নিত আদিমরা। এখনকার শিশুরা খেলার ছলে যেভাবে কাপড়ের তৈরি বিভিন্ন প্রাণীর মাথার আদলে বানানো টুপি নিজেদের মাথায় পরে, সেভাবে। এই ছদ্মবেশে ঐ প্রাণীর দলের মধ্যে ঢুকে পড়ত শিকারিরা। যেন টের না পায়, সেজন্য পশুপালের প্রাণীগুলোর মতোই অঙ্গভঙ্গি করে পালের মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নিত আদিম মানুষেরা। তারপর সুযোগ বুঝে একটি প্রাণীকে দলছুট করে ফেলত তারা। পৃথক করতে পারলেই কেল্লাফতে। খুলির মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসত শিকারিদের আসল চেহারা। ততক্ষণে প্রাণীটির আর কিছুই করার থাকত না। চারিদিক থেকে তীর বিঁধিয়ে ধরাশায়ী করা হতো মানুষের চেয়ে কয়েকগুন বেশি শক্তিশালী পশুটিকে।

শিকারের সময় শিকারি প্রাণীর অনুকরণ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। একটুখানি হেরফের হলেই প্রাণীগুলো বিপদের আঁচ পেয়ে পালাত। কিংবা প্রতিরোধ করত। তাই শিকারে যাওয়ার আগেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চলত প্রাণীদের অঙ্গভঙ্গির অনুকরণ। যা থেকেই নাচের উৎপত্তি। কিন্তু দলীয়ভাবে এই নৃত্য নাচার জন্য দরকার ছিল তাল বা ছন্দের। সবাই একসঙ্গে হাত নাড়াবে, পা দোলাবে, কিংবা পশুদের মতো তালে তালে হেলেদুলে হাঁটবে – এসব ছান্দিক কাজ করার জন্য প্রয়োজন ছিল তালবাদ্যের। কিন্তু আদিমকালে এখনকার মতো বাদ্যযন্ত্র ছিল না। তাই তারা গাছের শক্ত ডাল দিয়ে কাঠের শুকনা গুঁড়ির উপর আঘাত করে ‘ঠুক-ঠুক’ শব্দ উৎপন্ন করত। যা একপ্রকার শাব্দিক তাল তৈরি করে। এভাবেই নাচের সঙ্গে যুক্ত হলো বাজনা। কিন্তু গান কীভাবে যোগ হলো? আমাদের মূল বিষয় তো গানের উৎপত্তি খোঁজা। আদিম অন্ধকারে তা খুঁজে বের করার জন্য যে প্রদীপের প্রয়োজন ছিল, উপরের লেখাটুকু দিয়ে সেটির শিখায় আগুন জ্বালানো হলো মাত্র। এখন সলতের গোঁড়ায় ফুঁ দিলেই গানের উৎপত্তির হদিস মিলবে।

ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়া হারারি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বেশ পরিচিত লেখক। বিশেষ করে তার রচিত ‘সেপিয়েন্স’ বইটি মানুষের

1

চিন্তাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে উসকে দিয়েছে। তিনি ধারণা করেছেন, ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশের কারণ হিসেবে ‘পরচর্চা তত্ত্ব’ এবং ‘নদীর পাড়ে একটি সিংহ ছিল তত্ত্ব – এ দুটিই সঠিক। আরেকটু খুলে বলা প্রয়োজন। আড্ডা, খুনসুটি বা পরচর্চা করার জন্যই ভাষার বিকাশ ঘটেছে – এরকম তত্ত্ব ‘গসিপ থিওরি’ তথা পরচর্চা তত্ত্ব নামে পরিচিত। কিন্তু আদিম মানুষের পরচর্চার প্রয়োজন ছিল কি? হ্যাঁ, ছিল। দলগত শিকারের পুরো প্রক্রিয়ায়- কে মহড়ায় অংশ নিলো না, কে শিকারে সময় গা-ছাড়া ভাব দেখালো, কার দোষে শিকার ফসকে গেল, এসব বিষয়দি বলা-কওয়ার জন্যই তথা মনের রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই উদ্ভব হয়েছিল ভাষার। আবার, কোথায় কোন মহিষ দেখা গেছে তাই এখনই সেটির পিছু নিতে হবে, কোন দিক থেকে সিংহ আসছে তাই এখনই এ জায়গা ছেড়ে পালাতে হবে, কোন বনে কী ফল পেকেছে – এসব তথ্য দলের অন্যান্যদের কাছে প্রকাশ করার জন্যও ভাষা সৃষ্টির দরকার ছিল। এসব তাগিতেই তৈরি হতে লাগল শব্দের ও ভাষার। শব্দই তো গানের মূল মসলা।

মসলা তৈরি। কিন্তু গানের জন্য চাই সুর। চাই স্বরের ওঠানামা। সেটি কীভাবে হলো? শিকারে যাওয়ার পর ঐ প্রাণীকে বিভ্রান্ত করার জন্য সেটির ডাককে অনুকরণ করত আদিম শিকারিরা। মানুষ কখনো সেই অনুকরণ করত উচ্চস্বরে, কখনো নিম্ন আবার কখনো মাঝারি স্বরে। আবার দূরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যও মানুষ উচ্চশব্দ সৃষ্টি করত। তো, কণ্ঠের ওঠানামা তথা সুরের উৎপত্তি এভাবেই। যেই উদাহরণ এখনো ‘সা রে গা মা পা ধা নি সা’র মধ্যে দেখা যায়। স্বরের এই ওঠানামা বিভিন্ন শব্দের উপর প্রয়োগ হতে থাকে। ফলে ‘সুরযুক্ত স্বর’– এর সৃষ্টি হয়। যা মূলত গান। পাখির এমন সুরযুক্ত স্বরকেও গান বলা হয়। কিছু প্রজাতির তিমি ও ডলফিনও এ ধরনের সুরযুক্ত স্বর তৈরি করে। মানুষ সেগুলোকে গানই বলে। এমনকি কিছু প্রাণীর ডাক থেকে গানের স্বর নেওয়া হয়েছে। যেমন, ময়ূরের ডাক থেকে ষড়জ, ভেকের থেকে ঋষভ্‌, ছাগলের থেকে গান্ধার, ক্রৌঞ্চের থেকে মধ্যম, কোকিলের থেকে পঞ্চম, অশ্বের থেকে ধৈবত এবং হস্তীর ডাক থেকে নিষাদ। কিন্তু প্রাণীরা এমন সুরযুক্ত স্বর তৈরি করে কেন? চার্লস ডারউইনের মতামত, যৌনজীবনের সংস্পর্শেই সংগীতের উৎপত্তি। যেমন, বিশেষ ঋতুর আগমনে পাখির ডাক কেবলমাত্র মিলনের উদ্দেশ্যে। যা হোক, আদিম মানুষের হাতেতালি বাজানো, বুক চাপড়ে শব্দ তৈরি করা, নিতম্ব চাপড়াতে চাপড়াতে দৌড়ানো – এসবের মধ্যেও তাল ও ছন্দের বুনন হয়েছিল। যা পরে মৌখিক শব্দের উপর আরোপের মাধ্যমে সুরযুক্ত স্বর তথা গানের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

9

খণ্ড-খণ্ড এবং সুরযুক্ত অনর্থক স্বর তৈরির স্তর পেরিয়ে অর্থবহ, উদ্দেশ্যমূলক ও পুর্ণাঙ্গ গান তৈরি করতে মানুষের লেগেছে অনেক সময়। মানুষ শিকার-সংগ্রহ পর্যায় থেকে ক্রমশ কৃষিজীবী হয়ে উঠতে লাগল। কৃষি মানুষকে খাদ্যভাণ্ডার দিলেও উৎপাদনের নিশ্চয়তা দেয়নি। মানে, শিকারজীবী মানুষ তাদের চোখের সামনে শিকারকে দেখতে পেত। মোটাসোটা এক টুকরা জীবন্ত খাবার থাকত তাদের হাতের নাগালেই। কৌশল করে ধরতে পারলেই বেশ কিছুদিনের খাদ্যের জোগান হয়ে যেত। কিন্তু কৃষির বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। চাষীরা বীজ বপন করে আসার পরও নিশ্চিত হতে পারত না যে সেই বীজ থেকে চারা গজাবে কিনা, গজালেও তাতে শস্য ফলবে কিনা, ফললেও তা অন্যান্য পশুপাখির আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কিনা, বাঁচানো গেলেও বন্যার মতো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে সকল পাকা ফসল ধ্বংস করে দিয়ে যাবে কিনা ।কৃষিজীবী মানুষেরা এসব অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করত। তা ছাড়া উদ্বৃত্তভোগী দস্যুর উৎপাত তো ছিলই। এসব অনিষ্টকারী শক্তির কবল থেকে বাঁচতে তাদের প্রয়োজন ছিল ফসল ও নিজগোষ্ঠী রক্ষাকারী দেবতাকে সদা তুষ্ট রাখা। বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত সময়ে চলত এসব তুষ্টিকর্ম। রক্ষাকারী দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেসব কৌশল অবলম্বন করা হতো, গান সেগুলোর মধ্যে একটি।

শক্তিশালীরা মাঠে কাজ করত। দুর্বল বৃদ্ধরা বসতিতে বসে বসে গান ফেঁদে দেবতাদের তুষ্ট করায়ব্যস্ত থাকত। ততদিনে ভাষারও অনেক উন্নতি হয়েছে। আদিমকালে কিছু ট্রাইবদের মধ্যে বৃদ্ধহত্যার প্রচলন ছিল। দল থেকে অক্ষম লোকে কমিয়ে নিজেদের বোঝা হালকা করা এবং খাবারের ভাগীদার কমানোর জন্য বুড়ো লোকদের হত্যা করার চল ছিল। কিন্তু মানুষ শিকার ছেড়ে কৃষি গ্রহণ করার ফলে বৃদ্ধদের কাজে লাগানো গেল। কাজটি হচ্ছে বসতিতে বসে বসে নাচ-গান- বাজনা করে দেবতাদের তুষ্ট রাখা। ফলে বুড়ো লোকেদের জীবন রক্ষা পেল। সময়ের আগে মরতে হলো না। এখনো অনেক জায়গাতে দেখা যায় – বুড়ো মানুষেরা এমন অনেক গান কিংবা গল্প জানে যা তরুণেরা জানে না। আদিম কৃষি সমাজে বুড়োরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা পেতে যেসব গান ফাঁদতো, সেগুলো আদিম ধর্মীয় গান হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া গানের আরও অনেক শাখা-প্রশাখা আছে। সেগুলো নিয়ে নাহয় অন্য কোনোদিন আলাপ হবে।

মাল্টিমিডিয়া কিংডমের জন্য ফিচারটি লিখেছেন শিবলী আহমেদ।

ছবিঃ ইন্টারনেট